'মহুয়া' পালা একটি অসাম্প্রদায়িক প্রেম চেতনার নিদর্শন


মহুয়া পালা একটি অসাম্প্রদায়িক প্রেম প্রণয়ের নিদর্শন, কবি দ্বিজ কানাই প্রায় চারশত বছর আগেই এই মূল সত্যটি আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন প্রেম কোনো বাধাই বাধা থাকতে পারেনা। প্রেম কোনো জাতপাতের বাধায় থেমে যেতে পারেনা। প্রেম নদীর স্রোতের মত ,প্রেম হচ্ছে সর্বদায় বহমান একটি খড়স্রোতা নদী। তৎকালীন রক্ষনশীল সমাজ বেদে কন্যা মহুয়া সুন্দরী জমিদারের দেওয়ান সুদর্শন পুরুষ নদের চাঁদের ভালোবাসায় বারবার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু কোনো বাধাই দু'জনের মধ্যে আত্মিক দূরত্ব সৃষ্টি করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত দু'জনে আত্মহুতির মাধ্যমে প্রমাণ করেছে যে ভালোবাসা শাশ্বত।
                                              "জল ভর সুন্দরী কইন্যা, জলে দিছ ঢেউ
                                          হাসি মুখে কওনা কথা, সঙ্গে নাই মোর কেউ।"
বাংলার লোকগীতি বা গীতিকার ইতিহাস অনেক প্রাচীন সমৃদ্ধ। এগুলোর বিষয়বস্তুতে যেমন আছে বৈচিত্র্য, তেমনই বর্ণনা। কখনো প্রকৃতি আবার কখনো মানবীয় অনুভূতিপ্রেম-বিরহ, সুখ-দুঃখ, এমনকি গ্রাম বা সংসারের কলহ এসেছে বিষয়বস্তু হয়ে। তত্কালীন সামাজিক অবস্থা, ধর্মীয় অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন রূপকথা, উপকথা, যুদ্ধও রয়েছে এর মাঝে। রকম অনেক কিছুই ধরা আছে আমাদের গীতিকায় সরল ভাষায়, কখনো রূপক-উপমায়।                        
                                               "নয়া বাড়ী লইয়া রে বাইদ্যা বানলো জুইতের ঘর,
                                      লীলুয়া বয়ারে কইন্যার গায়ে উঠলো জ্বর।
                                     নয়া বাড়ী লইয়া রে বাইদ্যা লাগাইল বাইঙ্গন,
                                     সেই বাইঙ্গন তুলতে কইন্যা জুড়িল কান্দন।"
                       
বাংলার লোকগীতি বা গীতিকার ইতিহাস অনেক প্রাচীন সমৃদ্ধ। কবি দ্বিজ কানাই প্রণীত "মহুয়া" পালাটি মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের গীতিকা ধারায় একটি উল্লেখযোগ্য সম্পদ। দ্বিজ কানাই প্রায় ৩৭০ বছর পূর্বে এই পালাগানটি রচনা করেন, যা বর্তমানে 'নদের চাঁদ মহুয়া' পালা বা গাথা নামে পরিচিত। এটি একটি দৃশ্য কাব্য (প্রাচীন পল্লীনাটিকা) মৈমনসিংহ গীতিকায় ১০টি গীতিকা স্থান পেয়েছে, যার মধ্যে এটি অন্যতম। দীনেশ্চন্দ্র সেন রায়বাহাদুর সংকলিত এবং ১৯২৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত 'মৈমনসিংহ-গীতিকা' প্রথম খন্ড- থেকে পালাটি গদ্যে রুপান্তর করে গৃহীত হয়েছে।[] পালাটিতে মহুয়ার দুর্জয় প্রেমশক্তি  বলিষ্ঠ আত্মপ্রত্যয় কীভাবে মানবসৃষ্ট দুর্যোগ ধ্বংস হয়ে গেল তারই মরমী কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। গীতিকাটির কাহিনি গড়ে উঠেছে একটি অসাম্প্রদায়িক মানবিক প্রণয়কে কেন্দ্র করে। একদিকে ছয় মাস বয়সী চুরি হওয়া কন্যা অনিন্দ্যকান্তি মহুয়া অন্যদিকে জমিদারপুত্র নদের চাঁদ। তাঁদের অদম্য প্রেম সকল বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে চেয়েছে। কিন্তু বেদে সরদার হুম্রা সামাজিক, বৈষয়িক  মনস্তাত্ত্বিক কারণে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়। মৃত্যুই হয় তাদের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। প্রথম প্রহরের ঘন অন্ধকারের মাঝে চল্লিশোর্ধ্ব হুমরা সর্দার ধনু নদীর তীরে দাড়িয়ে আছেন। চোখ মুখের গভীর চিন্তা উত্তেজনায় পরিণত হয়ে ছড়িয়ে পরেছে পেশীবহুল শক্তসমর্থ দেহে, যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব নদী পার হয়ে চলে যেতে হবে কাঞ্চনপুর গ্রাম ছেড়ে। কুঞ্চিত ভ্রূ চেয়েও কালো চোখ, তারচেয়ে কালো শরীর, আর তারচেয়েও বেশি কালো অন্ধকারে ছোট ভাই মানিকের দিকে মশাল উঁচিয়ে ইশারা করতেই খুঁটি তুলে বজরা ছেড়ে দেয়া হলো। লাফিয়ে নৌকায় উঠে দ্রুত কিছু নির্দেশ দিয়ে নিজের ছোট প্রকোষ্ঠে অনুপ্রবেশ করলেন। প্রায় ২৫ থেকে ৩০ বছর ধরে কর্মরত আছেন  পেশায়, উত্তেজনা আর সম্পত্তির লোভে আক্ষরিক অর্থেই অসংখ্য মানুষ মেরেকেটে লাশের পাহাড় গড়েছেনগারো পাহাড় ছাড়িয়ে যাবে সেই লাশের পাহাড়। তবুও আজকের রাতের মতোন অনুশোচনা মেশানো উত্তেজনা আগে কখনো বোধ করেননি। কিছুক্ষণ আগেই কাঞ্চনপুর গ্রাম হানা দিয়েছেন দলবল নিয়ে। ঐশ্বর্যশালী ব্রাক্ষ্মণ বাড়িতে লুটপাট চালিয়ে যখন সবাই কিছুটা ক্লান্ত হয়ে বের হতে যাবে, তখন তার চোখ পরলো বৃদ্ধ ব্রাহ্মনের মাত্র ছয়মাস বয়সী কন্যার উপরে, যার স্বর্গীয় সৌন্দর্য্যের কাছে এতোক্ষণের অপহরণ করা ধনসম্পদ নিমিষেই তুচ্ছ হয়ে গেলো। এই দেবশিশু অপহরণ করার সামর্থ্য তার নেই, তাই ব্রাহ্মনের অলক্ষ্যে চুরি করে নিয়ে এলেন।

ষোল বছর কেটে গেছে। ডাকাতি ছেড়ে হুমরা বেদে হয়ে স্থায়ী হয়েছেন গারো পাহাড়ের অনেকটুকু উত্তরে যেখানে হিমানী পর্বত, তারও উত্তরে যেখানে বাঘ-ভাল্লুক ভিন্ন প্রানীর দ্যাখা মেলা ভার, সেই অন্ধকার জঙ্গলে। আর সেই শিশুকন্যা? সে থাকে হুমরা বেদের সাথেই, হুমরা তাকে খেলা শেখায়, বেদে কৌশল শেখায়। ষোড়শী কন্যাকে যেই দেখে সেই পাগল হয়- সাপের মাথায় যেমন থাইক্যা জলে মণি, যে দেখে পাগল হয় বাইদ্যার নন্দিনী। কাঁচা সোনা হয়ে হুমরা বেদের অন্ধকার ঘর আলোকিত করে রাখে সে, হাট্টীয়া না যাইতে কইন্যার পায়ে পরে চুল, মুখেতে ফুট্টা উঠে কনক চাম্পার ফুল। তার ডাগর ডাগর চোখের তাঁরার আলোয় পথ খুঁজে হুমরা তাকে নিয়ে দেশবিদেশ ঘুরে বেড়ায়। পাইয়া সুন্দরী কইন্যা হুমরা বাইদ্যার নারী, ভাব্যা চিন্ত্যা নাম রাখল মহুয়া সুন্দরী হুমরা বেদের খেয়াল হলো বিদেশে যাবে খেলা দ্যাখাতে। পরের শুক্রবার তোতা, ময়না, টিয়া, সোনামুখী দোয়েল, ঘোড়া, শিকারী কুকুর, চন্ডালের হাড় আরও কতো কী নিয়ে বের হলো হুমরা বেদের দল। আগে আগে হুমরা আর মানিক, পিছনে গলা ধরাধরি করে খুঁনসুটিতে মগ্ন মহুয়া আর তার সই পালঙ্ক। একদিন দুইদিন তিনদিন করে মাস গুয়াইলো, বামনকান্দা গ্রামে যাইয়া উপস্থিত হইলো।
বামনকান্দা গ্রামের জমিদারের দেওয়ান নদের চাঁদ আজ নিয়ম ভেঙে নিয়মিত সভা বসিয়েছেন সন্ধ্যার খোলা আকাশের নিচে। সভায় তার মন নেই, তাকিয়ে আছেন পূর্ন চাঁদ আর তাঁরা ভরা আকাশের দিকে। আস্থাভাজন একজনের কাছে খবর পেয়েছেন গ্রামে এক বেদের দল ভিড়েছে। বেদের দলের হরেক তামশায় তার উৎসাহ নেই, শুনেছেন দলের সাথে এক অসম্ভব রূপবতী নারী এসেছে যার তূলনা নাকি বামনকান্দা তো বামনকান্দা, গোটা জমিদারীতেই নেই। একদিকে সুন্দরী নারীর মোহ, অন্যদিকে মায়ের আপত্তিতে নদের ঠাকুর বেদের দলকে আমন্ত্রণ জানাবেন নাকি জানাবেন না সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। সভা ভঙ্গ করে অন্দরমহলে পৌছে মায়ের কাছ থেকে বার-বাড়িতে বেদের আসর বসানোর অনুমতি নিয়েই ছুটলেন আয়োজন করতে। রাতে বামনকান্দা গ্রাম ভেঙে পরলো ঠাকুরবাড়ির বার-বাড়িতে। সাপের খেলা হলো, নাচ হলো, গান হলো, নদের চাঁদের অপেক্ষা আর ফুরোয় না। "অবশেষে যখন নাকি বাইদ্যার ছেরি বাশে মাইলো লাড়া, বইস্যা আছিল নদ্যার ঠাকুর উঠ্যা ঐল খাড়া। দড়ি বাইয়া উঠ্যা যখন বাশে বাজী করে, নইদ্যার ঠাকুর উঠ্যা কয় পইরা নাকি মরে।" মহুয়ার রূপে-গুণে মুগ্ধ নদের চাঁদ তৎক্ষণাৎ প্রেমে তো পরলেনই, হাজার টেকার শাল দিলেন আরো টেকা কড়ি, বসত করতে হুমড়া বাইদ্যারে দিলেন একখান বাড়ী। উদ্দেশ্য মহুয়া বামনকান্দায় স্থায়ী হোক। হুমরা বেদে উপহার গ্রহণ করলেন, পাশের গ্রাম উলুয়াকান্দায় গিয়ে বাড়ি বানালেন।
                                        "কাইন্দ না কাইন্দ না কইন্যা না কান্দিয়ো আর,
                                    সেই বাইঙ্গন বেচ্যা দিয়াম তোমার গলায় হার।
                                    নয়া বাড়ী লইয়ারে বাইদ্যা লাগাইলো উরি,
                                   তুমি কইন্যা না থাকলে আবার গলায় ছুরি।
                                  নয়া বাড়ী লইয়ারে বাইদ্যা লাগইলো কচু,
                                  সেই কচু বেচ্যা দিয়াম তোমার হাতের বাজু।
                                  নয়া বাড়ী লইয়ারে বাইদ্যা লাগাইলো কলা,
                                 সেই কলা বেচ্যা দিয়াম তোমার গলার মালা।
                                 নয়া বাড়ী লইয়ারে বাইদ্যা বানলো চৌকারী,
                               চৌদিগে মালঞ্চের বেড়া আয়না সাড়ি সাড়ি।
                               হাস মারলাম কইতর মারলাম বাচ্যা মারলাম টিয়া,
                                ভালা কইর্যা রাইন্দো বেনুন কাল্যাজিরা দিয়া।"

সেই রাতের পর অনেকদিন দ্যাখা নেই মহুয়ার। সারাদিন খেলা দেখিয়ে, গান গেয়ে সন্ধ্যায় নতুন বাড়িতে পৌছে সে, একটি বারের জন্যও ঠাকুর বাড়িতে পা দেয় না। নদের চাঁদ ভাবে মহুয়া বুঝি তাকে উপেক্ষা করে যাচ্ছে। সইতে না পেরে এক সন্ধ্যায় মহুয়ার পথ আগলে দাড়ায় নদের, বলে আগামীকাল সন্ধ্যায় সূর্য যখন ডুবি ডুবি করবে, মহুয়ার উপস্থিতিতে চাঁদ স্পর্ধা দ্যাখাবে আকাশে উঠার, তখন সে য্যানো নদীর ঘাটে এক মুহূর্তের জন্য হলেও আসে। নদের বলে, সইন্ধ্যা বেলা জলের ঘাটে একলা যাইও তুমি, ভরা কলসী কাঙ্কে তোমার তুল্যা দিয়াম আমি। মহুয়া আর দাড়ায় না, তবে পরের সন্ধ্যায় নদীর ঘাটে বসে পানিতে পা ডুবিয়ে ঠিকই বসে থাকে মহুয়া। সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে নদের আসলে মহুয়া মিছেমিছি রাগ প্রকাশ করে। সেই রাগ ঢেউ হয়ে নদের চাঁদকে ভিজিয়ে দেয়। নদের ভেবে পায় না অ্যামন রূপবতী নারী বেদের দলে ভীড়ে কী করে। জিজ্ঞেস করলে অভিমানী কন্ঠে ছলছল করে মহুয়া, নিজেকে স্রোতের শ্যাওলা দাবী করে, ভাইবোন তো দূরে থাক, তার পিতামাতা আছে কিনা তাও জানেনা। সহমর্মিতা প্রকাশের ছলে মনের কথা বলে ফেলে নদের, সেও অবিবাহিত, তবে মহুয়ার মতোন রূপবতী কন্যা পেলে বৌ বানাতে একমুহূর্ত দেরি করবে না। মহুয়া কপট রাগ প্রদর্শন করে তিরস্কার করে নদের চাঁদকে-
                                    “লজ্জা নাই নির্লজ্জ ঠাকুর লজ্জা নাইরে তর,
                                      গলায় কলসী বাইন্দা জলে ডুইব্যা মর।
                             কোথায় পাইবাম কলসী কইন্যা কোথায় পাইবাম দড়ি,
                                      তুমি হও গহীন গাঙ আমি ডুইব্যা মরি।"
ফাগুন চলে এসেছে। ফসলে পাঁক ধরেছে, হুমরা বেদের নতুন বাড়িতে এই নিয়ে উতসবের আমেজ। এতোসবের মধ্যেও মহুয়ার ঔদাসীন্য চোখ এড়ায়নি হুমরা বেদের। সেদিন বার-বাড়িতে বসে কথা হচ্ছিলো মহুয়া আর পালঙ্কের মধ্যে। কিছুদিন ধরেই মহুয়ার উপর লক্ষ্য রাখছিলো পালঙ্ক, ঘাটে নদের ঠাকুরের সাথে যেদিন মহুয়ার দ্যাখা হলো, সেদিনের পর মহুয়ার লুকিয়ে লুকিয়ে কান্না দেখে কিছুটা আঁচ করতে পেরেছে। ইতিমধ্যেই রটে গেছে মহুয়া আর নদের চাঁদের গোপন প্রণয়ের কথা। পালঙ্ক মহুয়াকে পরামর্শ দেয় এক সপ্তাহ বাইরে না বেরুবার, ঠাকুরবাড়িতে সে পৌছে দেবে মহুয়ার মৃত্যুর খবর। রাজি হয়না মহুয়া, উল্টো ঠাকুরবাড়ির পানে চেয়ে চন্দ্র-সূর্য আর পালঙ্ক সইকে সাক্ষী মেনে নদের চাঁদকে স্বামী বলে ঘোষণা করে, পালিয়ে যাবে সে, নতুবা বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করবে। হুমরা বেদে মহুয়াকে কিছু বলে না, তবে গোপনে দলবল নিয়ে পালিয়ে যাবার ব্যাপারে পরামর্শ করে মানিকের সাথে। কিছুদিনের মধ্যেই ফসল উঠবে ঘরে, একদিকে নতুন গৃহস্থের টান, বাড়ির পেছনের মাছভর্তি পুকুর, অন্যদিকে ঠাকুরবাড়ির সাথে বেদেকন্যার গোপন প্রণয়ের আশঙ্কা, কী করবে ভেবে পায়না তারা।

নদীর তীর ঘেঁষে শালি ধানের ক্ষেতের আলে বাঁশি হাতে দাড়িয়ে আছে নদের চাঁদ। একটু পরপর আকাশ কাঁপিয়ে ডেকে যাওয়া পাপিয়া আর সে ছাড়াও আরও কেউ জেগে আছে এই মধ্যরাতেও, দূরে উলুয়াকান্দা গ্রামের বেদের ঘরে মিটিমিটি আলো দেখে ভাবে নদের। বাঁশির সুর য্যানো ঘুম ভাঙানিয়া গান হয়ে ডেকে আনে মহুয়াকে। পরস্পরকে আলিঙ্গন করে হয়তো চুমুও খায়। দুজনেই জানে প্রণয় বিরহে পরিণত হতে দেরি হবে না, মহুয়া তাই প্রস্তাব করে নদীর জলে ডুবে মরে যাওয়ার। নদের চাঁদ যদি ফুলে হতে পারে তাহলেই কেবল মহুয়া তাকে মাথায় গুঁজে সর্বক্ষণ একসাথে থাকতে পারে। কিছুক্ষণ পর পাপিয়ার সাথে আরেকজনের চলে যাওয়া টের পায় তারা, তবে ঠিক বুঝতে পারেনা ঠিক কখন থেকে হুমরা বেদে নজর রাখছিলো তাদের উপর। তারপর ভোর হওয়ার আগেই বিদায় নিয়ে যার যার বাড়িতে পৌছে। পরদিন সন্ধ্যায় নদীর ঘাটে পানি আনার ছুতোয় নদের চাঁদের সাথে দ্যাখা করতে যায় মহুয়া। আজ রাতে যেকোন সময় তাকে নিয়ে হুমরা বেদের দল উলুয়াকান্দা ছেড়ে যাবে। আর কখনো নদের চাঁদ সন্ধ্যায় মহুয়ার কাকে কলসী তুলে দেবেনাতার বাঁশি শুনে মধ্যরাতে দীর ঘাটে আসা হবেনাএই নতুন বাড়িতে বসে গান গাওয়া হবেনানতুন শালি ধানের চিড়া খাওয়া হবেনা  ভেবে কান্নায় ভেঙে পরে মহুয়া, আবার মানসম্মানের প্রশ্নে বাবার সাথে ফিরে যেতেই হবে। মহুয়া কসম খাওয়ায় নদের চাঁদকে, সময় পেলে য্যানো উত্তরের দেশে গিয়ে দেখে আসে মহুয়াকে। সেখানে তাদের দক্ষিনমুখো বাড়িতে নদেরকে পিঁড়ি পেতে বসিয়ে শালি ধানের চিড়া আর শবরী কলা খাওয়াবে, আর তিন বেলা মোষের দুধের দই। এই বলে ছুটে যায় মহুয়া, খানিক পর বাঁশ লইল দড়ি লইল সকল লইয়া সাথে, পলাইল বাইদ্যার দল আইন্ধ্যারিয়া নিশিতে।[]
পালাগানটি অসাম্প্রদায়িক একটি চেতনাকে নির্দেশ করে নইদ্যা ঠাকুর মহুয়া সুন্দরীর অমর প্রেমকথার মাধ্যমে। কবি দ্বিজ কানাই এক শান্তিপূর্ণ সমাজ বিনির্মানের স্বপ্ন দেখেছিলেন যেখানে থাকবেনা কোনো জাতিগত বিভেদ,থাকবেনা কোনো বর্ণবৈষম্য,থাকবেনা কোনো আঞ্চলিক বিভেদ। কবির এই স্বপ্ন আংশিক পূরণ হয়েছে ঠিকই কিন্তু আধুনিক সমাজে ধর্মগত বৈষম্য আজোও রয়ে গেছে। সুতরাং তৎকালীন সমাজ-বাস্তবতা সহ পালাটি দুর্জয় এবং অমর প্রেমের একটি অপূর্ব নিদর্শন।

তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া ও বাংলাপিডিয়া

Comments